প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিত্ রায় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতায় পরলোকগমন করেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং তার কাজের পরিমাণও বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উত্সবে পাওয়া ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল (ইবংঃ ঐঁসধহ উড়পঁসবহঃ)' পুরস্কারটি। পথের পাঁচালি, অপুর সংসার ও অপরাজিত—এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে বলা হয় ‘অপুত্রয়ী’ এবং এগুলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে স্বীকৃত। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরেও কাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ১৯৯১ সালে পাওয়া একাডেমি পুরস্কার (অস্কার)। ১৯২১ সালের ২ মে সত্যজিত্ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়। বাংলা সাহিত্যের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র উপেন্দ্রকিশোর রায় ও সুকুমার রায় ছিলেন তার পিতামহ ও পিতা। সত্যজিত্ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তার কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ রেনোয়ার সংস্পর্শে এবং লন্ডন সফরে ইতালীয় ছবি ‘বাইসাইকেল থিভস’ দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।
উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ আলী আকবর খান ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। সরোদ বাদনে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের যে ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা পশ্চিমাঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল আলী আকবর খানের হাত ধরেই। সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তবলা শেখেন চাচা ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছে।
১৯৫৫ সালে তিনি বিখ্যাত বেহালাবাদক ইয়েহুদি মেনুহিনের আমন্ত্রণে আমেরিকা যান এবং পরবর্তী সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ী হন। আলী আকবর খান ৫ বার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ভারতের পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন।।
আলী আকবর খানের জন্মের কিছুকাল পরই তাদের পরিবারটি কুমিল্লা ছেড়ে মাইহারে পাড়ি জমায়। ১৯৩৬ সালে ১৩ বছর বয়সে এলাহাবাদে তিনি প্রথম কনসার্টে অংশগ্রহণ করেন। বাবার সুপারিশে তিনি যোধপুরের মহারাজার দরবারে প্রধান সঙ্গীতজ্ঞের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। জীবনে তিনবার তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ২০০৯ সালের ১৮ জুন ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ম্যাক আর্থার ফেলোশিপ এবং ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপের এনডাওমেন্ট ফর দ্য আর্টস পুরস্কারও লাভ করেছিলেন
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ নিতীন বসু ১৯৮৬ সালের ১৩ এপ্রিল (মতান্তরে ১৪ এপ্রিল) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে পরিচালক, চিত্র নাট্যকার।
তার আদিনিবাস বাংলাদেশের ময়মনসিংহের জয়সিদ্ধিতে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ সালের ২৬ এপ্রিল কলকাতায়। তার বাবা হেমেন্দ্র মোহন বসু ছিলেন ব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই নিতীন ফটোগ্রাফিতে (আলোকচিত্র বিদ্যা) আকৃষ্ট ছিলেন। বাবার কাছে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত বহু বিষয়ে বিশেষ করে ফটোগ্রাফিতে তার হাতেখড়ি। ১৯৩৫ সালে তার পরিচালনায়ই সর্বপ্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্যে কণ্ঠদান প্রথার শুরু। ক্যামেরার কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিত্র পরিচালনাও শুরু করেন। তার পরিচালিত কুড়িটি ছবির মধ্যে চণ্ডীদাস, জীবনমরণ, দেশের মাটি, দিদি, কাশীনাথ উল্লেখযোগ্য।
নিতীন বসু ১৯২২ সালে ইংরেজি বিষয়ে প্রথম হয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে বিএসসিতে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দেননি। ১৯৪৬ সালে তিনি নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে বোম্বের চিত্রজগতে যান। সেখানে প্রায় কুড়িটি ছবি করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃত্ হিসেবে ১৯৭৮ সালে সে দেশের সরকার তাকে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত করেন।
১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন প্রত্নতত্ত্ব, উত্কীর্ণ লিপিতত্ত্ব ও প্রাচীন হস্তলিপি বিষয়ের পথপ্রদর্শক ও সাহিত্যিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মতিলাল ও কালিমতি ছিলেন তার পিতামাতা। রাখালদাস ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯১০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কর্তা হিসেবেই তিনি বহুল পরিচিত। তিনিই প্রথম আদি বাংলালিপির প্রতি পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রে ‘প্রাচীন মুদ্রা, প্রথম পর্ব (বাংলায় লিখিত)’ ছিল রাখালদাসের একটি বড় অবদান।
ভারতীয় শিল্পকলার চর্চায় রাখালদাসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো তার মৃত্যুর পর ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ইস্টার্ন ইন্ডিয়ান মেডিয়েভাল স্কুল অব স্কাল্পচার গ্রন্থটি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দ্য অরিজিন অব দ্য বেঙ্গলি স্ক্রিপ্টসের জন্য ১৯১৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মর্যাদাকর জুবিলী গবেষণা পুরস্কার লাভ করেন। পশ্চিম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে তিনি গ্রিক বিজয়স্তম্ভের সন্ধানে সিন্ধু অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং ঢিবির শীর্ষদেশে বৌদ্ধবিহারের খননকালে তিনি এমন কতগুলো নিদর্শনের সন্ধান পান যা তাকে হরপ্পায় সাহানী কর্তৃক প্রাপ্ত অনুরূপ নিদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ সভ্যতা সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও গ্রন্থে।
১৯১০ সালে রাখালদাস কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা এবং ১৯১১ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগে সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এছাড়া ১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৩০ সালের ২৩ মে কলকাতায় তিনি পরলোকগমন করেন।
উপমহাদেশের বরেণ্য চিত্রকর যামিনী রায় ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা জেলার বেলিয়াতোর গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি যা শিখেছিলেন তা ছিল গতানুগতিক। ১৯০৮ সালে ফাইন আর্টে তিনি ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন। অচিরেই তিনি অনুধাবন করেন যে আঁকাআঁকির ব্যাপারে পশ্চিমা ধারার পরিবর্তে নিজস্ব সংস্কৃতিই হবে উত্তম অনুপ্রেরণা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্যে এ জন্যই তিনি লোক এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বেছে নিয়েছিলেন। কালিঘাট পটচিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে তিনি ইমপ্রেসনিস্ট ল্যান্ডস্কেপ ধারা থেকে সরে আসেন। সাঁওতালদের সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে তিনি নিজস্ব ধারার পরীক্ষা চালান। শিল্পকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে সমাজের সর্বত্র রূপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি; যাতে ভারতীয় চিত্রকলার আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। ১৯৫৪ সালে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্ট মিউজিয়ামে তার চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। নিজেকে তিনি পটুয়া পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৫ সালের ৯ এপ্রিল রাজবাড়ীর পাংশায় জন্মগ্রহণ করেন শিশুসাহিত্যিক, শিশু সংগঠক ও সাংবাদিক রোকনুজ্জামান খান। দাদা ভাই নামেই তিনি বহুল পরিচিত। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার পিতামহ মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী ছিলেন মাসিক কোহিনূর পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৪৮ সালে দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার মধ্য দিয়ে সংবাদপত্র জগতে তার য...াত্রা শুরু। তিনি ওই পত্রিকার শিশু বিভাগের সম্পাদক ছিলেন।১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন মফস্বল সম্পাদক হিসেবে। একই সালে তিনি ইত্তেফাকের শিশু বিভাগেও দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এ পত্রিকার সাহিত্য এবং ফিচার বিভাগের প্রধান হন। ১৯৫৬ সালে তিনি কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বাংলা একাডেমী এবং ১৯৯৪ সালে শিশু একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। আজব হলেও গুজব নয়, হাট্টিমাটিম টিম এবং খোকন খোকন ডাক পাড়ি তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। ২০০০ সালে তিনি মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ছিলেন শিশুর মতো সরল। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অগ্রপথিক।১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী মঙ্গল পাণ্ডে ১৮৫৭ সালের ৮ এপ্রিল কলকাতার ব্যারাকপুরে শহীদ হন। বলা যায় সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রদূত তিনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সাধারণ সিপাহী হলেও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মূল নায়ক ছিলেন তিনিই। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ পাণ্ডে প্রথম তার... ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে আক্রমণ করে এই বিদ্রোহের সূচনা করেন। কথিত রয়েছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ-ভারতে সিপাহীদের মধ্যে যে কার্তুজ সরবরাহ করত, তা ছিল প্রাণীর চর্বিমিশ্রিত। উল্লেখ্য, শূকর এবং গরু মুসলিম ও হিন্দুধর্মে নিষিদ্ধ। তাই যখন সিপাহীদের মধ্যে রটে গেল তারা যে কার্তুজ ব্যবহার করছে তা গরু কিংবা শূকরের চর্বিমিশ্রিত, তখন তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কারণ দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে কার্তুজের খোসা ছাড়াতে হতো। বিশেষ করে, মঙ্গল পাণ্ডে ছিলেন ধর্মভীরু। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদে তিনি ফুঁসে ওঠেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈন্যদের সংগঠিত করেন। ১৮২৭ সালের ১৯ জুলাই পাণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন উত্তর প্রদেশের নাগওয়ায়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পাণ্ডেকে আটক করে ১৮৫৭ সালের এই দিনে ফাঁসিতে ঝোলায়।